অ্যানথ্রোপোসিন: আধুনিকতার ‘সাজানো বাগানে’ বিশৃঙ্খলা

অ্যানথ্রোপোসিন! গালভরা এই শব্দটা জ্ঞান-বিজ্ঞানের ডিসকোর্সে ইদানিং প্রায় সাধারণ হয়ে পরেছে। মূলত বর্তমান সময়ের ভূতাত্ত্বিক কালপর্ব নির্দেশে শব্দটি ব্যবহার করা হলেও, এর মধ্যে রয়েছে ভূতত্ত্বের বাইরেও প্রায় সকল বিদ্যাজাগতিক শাখাকে নাড়া দেবার অভূতপূর্ব শক্তি। আর এই শক্তির উৎস হল এই শব্দে প্রোথিত রয়েছে যে ধারণা, সেটি। মূলত এন্থ্রোপোসিন বলতে চায় যে বর্তমান সময়ে পৃথিবী সত্যিকার অর্থে এক নতুন যুগে (epoch) পদার্পণ করেছে, যে যুগে মানুষ তার বহুবিধ কর্মকান্ডের জোরে হয়ে উঠেছে পৃথিবী পরিবর্তনকারী বলসমূহের মধ্যে একটি! এবং এর ফলস্বরূপ ক্রমশ প্রকট পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে দিনে দিনে পৃথিবীর জলবায়ুতে, যা নিরবচ্ছিন্ন থাকলে এই গ্রহের প্রতিবেশের সম্পূর্ণ ভোল পালটে যেতে পারে একসময়। অর্থাৎ কিনা ঘটে যেতে পারে বর্তমান প্রাণবৈচিত্রের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি, ষষ্ঠবারের মত!

কি বিশাল এক চিন্তা! একটা শব্দের মধ্যে এতকিছু! আর এই এতকিছু নিয়ে যবে থেকে এই শব্দের প্রস্তাবনা করেছেন নোবলজয়ী ভূ-রসায়নবিদ পল ক্রাটজেনতখন থেকেই গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, মানবিক জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাপ্রশাখায়। বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনার দুয়ার নতুন করে খুলে গেছে, যদিও এর পরেও বহুদিন জলবায়ু পরিবর্তনের অস্বিকৃতি অব্যাহত ছিল। তবে ২০১৫ সালের পর থেকেই একের পর এক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলবায়ু পরিবর্তনগত দুর্যোগ আমাদের কেবলই মনে করিয়ে দিচ্ছে- বিস্মরণ বা অস্বিকৃতিতে সমস্যা চলে যায় না, বরং ক্রমে শক্তি সংগ্রহ করে আরো বিকাশ লাভ করে।

অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল ২০২০ সালে আতঙ্কজনক আকার ধারণ করেছিল (ছবি- এবিসি)

এই ক্রমবর্ধমান আলোচনার জের ধরেই বোধ করি ২০১৫ সালে প্যারিসে জলবায়ু বিষয়ক চুক্তি সাক্ষর করে বিশ্বের ১৯৬ টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা। চুক্তি ভাল জিনিস বৈকি- যদি তাকে মানা হয়। ২০২১ সালে এসেও আমরা দেখতে পাই উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখনো জীবাশ্ম জ্বালানীর ভক্তি কাটিয়ে উঠতে পারছে না, আর আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কথা নাহয় বাদই দিলাম।

যা হোক আমরা আমাদের আলাপে ফিরে আসি! যদিও জীবাশ্ম জ্বালানীর (fossil fuel) কথাই বলতে হচ্ছে আবার- এনথ্রোপোসিন নিয়ে, জলবায়ু নিয়ে কথা বলতে গেলে অবধারিত ভাবেই মানুষের জ্বালানীর অশেষ তৃষ্ণার কথা আনতেই হয়। কারণ অনেক বিশেষজ্ঞরাই মনে করেন যে পৃথিবীর পথে মানুষের আবির্ভাবের সময় থেকেই (১০০০০ বছরেরও আগে) এবং কৃষির বিকাশের কাল অবধি মানুষ যদিও ক্রমাগতভাবেই পৃথিবীর পরিসরসমূহের পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করেছে, এই পরিবর্তনের পথে এক বিশাল ধাক্কা দিয়েছে বিংশ শতকের আধুনিক শিল্পবিপ্লব। ইংল্যান্ডের এই ঐতিহাসিক বিপ্লবের সাথে জড়িয়ে আছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস, ফ্যাক্টরিজাত কালো ধোয়ার সাথে শহুরে জীবনের পরিচিতি আর পুঁজিবাদের বিস্তৃতির উপাখ্যান। তবে পন্ডিতেরা, যেমন হ্যারাওয়েআমাদের মনে করিয়ে দেন যে মানুষের খননমূলক (extractivist) ও অন্যান্য পরিবেশবিধ্বংসী কাজের সূত্রপাত হয়েছিল আরো আগেভাগেই- “The relocation of peoples, plants and animal; the leveling of vast forests; and the violent mining of metals preceded the steam engine…”5

ডনা হ্যারাওয়ের মত অন্যান্য নৃবিজ্ঞানীরাও অ্যানথ্রোপোসিন নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন। এবং শব্দটা নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগও আছে তাদের। যদিও ‘সভ্যতার’ এই ক্রান্তিকালে এসে ‘নামে কি যায় আসে’ বলে এই নিয়ে ভাবনায় পিছ-পা হতে পারেন অনেকে, তবে আমরা জানি নৃবিজ্ঞানে নামে যায় আসে! বিশেষ করে যদি সেই নামখানির সাথে তাদের জ্ঞানকান্ডের নামের ব্যুৎপত্তিগত মিল পাওয়া যায়!

(পরবর্তী পর্ব)

Save in Pocket:

তথ্যপঞ্জিঃ

১, ২, ৩ Emmett, Robert, Lekhan, Thomas (eds.), Whose Anthropocene: Revisiting Dipesh Chakrabarty’s “Four Theses”, 2016, RCC Perspectives: Transformations in Environment and Society

৪, ৫ Haraway, Donna J., Staying with the trouble: Making kin in the Cthulucene, 2016, Duke University Press